Wednesday, July 19, 2023

টেরিজ থীম - চার্লস চ্যাপলিন


১৯৫২ সনে চার্লি চ্যাপলিনের লাইমলাইট সিনেমার থিম ম্যুজিক যেটা, টেরিজ থিম- লিখেছিলেন চার্লি নিজেই। ভীষন জনপ্রিয়তা পায়। ২০ বছর পর এটি বেস্ট অরিজিনাল  ড্রামাটিক স্কোরের জন্য আকাডেমী পুরষ্কার পায় ( চ্যাপলিনের একমাত্র প্রতিযোগীতা মূলক অস্কার)। চ্যাপলিন ও তার দুই সহযোগী রেমন্ড র‍্যাশ এবং ল্যারী রাসেল ( রাসেল গার্সিয়া)। 
https://youtu.be/ahJXB4MlAFo

 পরবর্তী কালে এই টিউনের উপর বেস করে একটি লিরিক সমৃদ্ধ সংগীত সোজা বাংলায় গান রচনা হয়, যার শীর্ষনাম 'ইটারনালি' লিরিক লিখেছিলেন 'জিওফ পারসন্স ও জন টার্নার'... 

প্রাথমিক ভাবে গানটি রেকর্ড করেন ১৯৫৩ তে জিমি ইয়ং ( ইউ কে) 
https://youtu.be/LpghxdvU374
ও ভিক ডামোনে( ইউ এস)। 
https://youtu.be/fBN1xr8367A
পরে আরো রথী মহারথীরা যেমন বিং ক্রসবি, রজার হুইটেকার, এংগেলবার্ট, সলিল চৌধুরী...

সলিল চৌধুরী? কী ব্যাপার? ব্যাপার হচ্ছে ১৯৬১ তে ডিডি কাশ্যপের পরিচালনায় দেব আনন্দ অভিনীত মায়া ছবিতে ঐ ম্যুজিক ব্যবহার করে রফি সাহেবকে দিয়ে গান করান সলিল চৌধুরী, গানটি ছিল ' জিন্দেগী হ্যায় ক্যা, সুন মেরী জান' গানটি লিখেছিলেন মজরু সুলতানপুরী। 
https://youtu.be/YvK4JVLWCWk
সলিল বাংলাতেও এটি করেন
https://youtu.be/AZrcHgS_37s

তার আগেই ১৯৫৯ নাগাদ গুরু দত্ত তার বন্ধ করে দেওয়া ছবি, 'রাজ'এর জন্য আর ডি বর্মন'কে দিয়ে রেকর্ড করান। পরে আর ডি সেই সুর কিছুটা বদলে ১৯৭২এ বম্বে টু গোয়া ছবিতে কিশোর-লতা ডুয়েটে আনেন ' তুম মেরী জিন্দেগীমে' এই গান ছবি থেকে বাদ পরে যায়। 
https://youtu.be/PN0rH8dLn28

আবার এই সুর আরেকটু পালটে ১৯৭৭এ মুক্তি ছবিতে ('ম্যায়জো চলা পী কর')
https://youtu.be/FjkqVKEzPFw
 ও১৯৯১এর বাংলা ছবি দেবতা'য় (কী করে জানলে তুমি) শোনালেন।
https://youtu.be/pTc_LC4ny1U

১৯৯৩ তে মহেশ ভাটের ফিল্ম গুনাহ'তে একই ম্যুজিক ব্যবহার করলেন রাজেশ রোশান, ইয়ে রাত ইয়ে তানিহাইয়া... 
https://youtu.be/YSQMQy-IRS0

কদিন আগেই কোনো একটা বিজ্ঞাপনে শুনলাম সেই সংগীত আবার.. ১৯৫২-২০২৩ চার্লি চলছেনই।

ঋণ - 

Ashish Rajadhyaksha; Paul Willemen;  Encyclopedia of Indian Cinema. Routledge. 

R. D. Burman: The Man The Music - Anirudha Bhattacharjee and Balaji Vittal. Harper Collins

Vance, Jeffrey. Chaplin: Genius of the Cinema. New York: Harry N. Abrams

#roadsidepicnic

লেখার কোনোও কপিরাইট নেই, লেখকের নাম সহ বা নাম ব্যাতিরেক যে কেহই ইহা অবাণিজ্যিক ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করিতে পারেন।

Saturday, May 14, 2022

মৃণাল সেন সম্পর্কে দুটি বা তিনটি কথা যা আমরা জানি - তমাল বোস

 পাড়ার এক দাদাকে একবার জিজ্ঞেশ করেছিলাম আচ্ছা কাস্তে হাতুড়ি তো জানি, কিন্তু ঐ তারাটার রহস্য কি? তিনি বলেছিলেন ঐ তারার পাঁচটা কোন পাঁচ জন মানুষের জন্য, মার্কস এঙ্গেলস লেনিন স্তালিন আর মাও। ব্যাখ্যা ভুল না ঠিক তার আর খোঁজ করিনি কখনো কারন ব্যাখ্যাটা খুব ভালো লেগেছিল। 
 বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও অমন কোনো তারা থাকলে তার পাঁচটা কোনে যে পাঁচজন মানুষ কে আমরা ভাববো তারা হচ্ছেন বারীন সাহা, ঋত্বিক কুমার ঘটক, সত্যজিৎ রায়, নিমাই ঘোষ এবং মৃণাল সেন। নিমাই ঘোষ এবং বারীন সাহা খানিকটা অপ্রচলিত কিন্তু বাকী তিনজন মহীরুহসম এবং তাল ঢ্যাঙ্গা , এদের মধ্যে একমাত্র মৃণাল সেনকেই চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা করতে পেরেছিলাম একটা নিউজ ম্যাগাজিনের সৌজন্যে।

         নিমাই ঘোষ 

    বারীন সাহা
 
 বেলতলার বাড়ীতে ওনার  জন্মদিনে আমরা গিয়েছিলাম।সেখানে উনি আমাদের বলেন “চলো বড়লোকের ঘরে বসে কথা বলি”- আমরা অবাক, বড়লোকের ঘর কী, না সেটা ওনার শোবার ঘর আর সেখানে একটা এসি লাগানো আছে, নিজের বাড়ীর অন্দরে এভাবে আগে নিয়ে গেছিলেন পরিতোষ সেন।

    পরিতোষ সেন

 যিনি তাঁর বাসার অন্দরে আমাদের সাবলীল আত্মীয়তায় নিয়ে যান তিনি তাঁর কাজের, ভাবনার, মননের অন্দরে ঢোকার বেলায় আমাদের কিন্তু একটু সমস্যায় ফেলেন, একটু বুঝে পা ফেলতে হয়, কারন ফরাসী জঁ লুক গোদারের রাজনৈতিক  সিনেমা কর্তৃপক্ষকে যেভাবে সোজা আঘাত করতে পারে মৃণাল সেন সেভাবে পারেন না, সামাজিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই, যেমন পাসোলিনি তাঁর “গসপেল আকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’তে বা বুনুয়েল তাঁর ভিরিদিয়েনায় যেভাবে চার্চকে সরাসরি আক্রমন হানেন সেভাবে  ঋত্বিক কুমার ঘটক সোজা হামলা করতে পারেন না তাকে বহু রুপকের আশ্রয় নিতে হয় আর হয়ে পড়েন জটিল, একই ভাবে মৃণাল সেন’কেও তাঁর ছবিতে হয় জটিল হয়ে যেতে হয়েছে বা পাখী পড়ানোর মতন করে দর্শককে বোঝাতে হয়েছে । যে কারনে তপন সিংহ, তরুন মজুমদার, অজয় কর বা কিয়দংশে সত্যজিৎ রায় বক্স সফল পরিচালক ঠিক তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক-মৃণাল। 

    গসপেল আকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু ছবির দৃশ্য

    লাস্ট সাপারের অনুকরনে সাজানো ভিরিদিয়েনার সেট।
 
 গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বিশেষ বন্ধু মৃণাল সেন নিজেকে বলতেন প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট। মৃনাল সেন ,ঋত্বিক ঘটক ও সলিল চৌধুরি তিনজন ছিলেন ভীষণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু,একেবার হরিহর আত্মা যাকে বলে । চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাস তিনজনেরই । স্বপ্ন দেখতেন সমাজ বদলাবার , আর তার হাতিয়ার হবে চলচ্চিত্র । তিনজনই কম্যুনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা IPTA এর সদস্য। (মৃণাল পার্টি সদস্য হন নি) দু’ পয়সায় সিগারেট খেতেন, তাও অনেক সময় বাকীতে। ঋত্বিক খেতেন বিড়ি, দু’ পয়সায় তিরিশটা’র প্যাকেট । তাতেও বাকী পড়েছিল- সেদিনের আশি টাকা। খবর পেলেন বোম্বে থেকে পালিয়ে এসেছে এক ছেলে । কলকাতার এক বস্তিতে থাকে তার খাবারও পয়সা নেই। বোম্বের চলচ্চিত্র রাজনৈতিক কারণে তাকে বয়কট করেছে। রাজনীতি সেই তখন থেকেই সেখানে অচ্ছ্যুৎ । তিনিই হচ্ছেন পরবর্তি কালে বিখ্যাত বাংলা নাটকের আলোক সম্পাতকারী তাপস সেন।দু’দিন না খেয়ে মৃণাল সেনের কাছে এলেন "দু’দিন খাইনি । একটা টাকা দিতে পার ?" মৃণালের পকেটে তখন তিনটে টাকা। দিদি ফিলমের বই কিনতে টাকাটা দিয়েছেন। তার থেকেই তাকে খাইয়ে টাকাটা দিলেন ।

প্রচুর পড়াশুনা করতেন তখন থেকেই  সাহিত্য ,সঙ্গীত আর রাজনীতি তো ছিলই ।একদিন ট্রেনে ‘A case of communism’ (বইটার সঠিক নামটা মনে করতে পারছিনা এতদিন পর,তবে এ রকমই কিছু ) হাতে পেয়ে পড়তে পড়তে কেমন করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়েন নির্দিষ্ট ষ্টেশন ছেড়ে অন্যপথে বহুদুর চলে গেলেও টের পাননি । এমনিতে পয়সার অভাবে বিনা টিকিটে ভ্রমন করতেন, তো আবার ফিরতি ট্রেনে চড়েন ইতিমধ্যে ৬০ পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে । সেদিনই গীতার (পরবর্তিতে তার স্ত্রী গীতা সেন) সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা যা আজকের ভাষায় ডেটিং-সেই অবস্থায় এক ব্রীজের উপরে দেখা হয়েছিল এবং তার প্রথম হাত ধরার কাঁপুনি এবং তখনই বইটাও ব্রীজের উপর থেকে জলে পড়ে তলিয়ে যায় । সে বই আর পড়া হয়নি।
     গীতা সেন ও মৃণাল সেন

 ঋত্বিক কাবুলীর কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন সিনেমা করার জন্যে । প্রতি ১০০ টাকা ধার নিলে প্রতি মাসে ১০/- সুদ । কাবুলীদের কিভাবে ফাঁকি দিয়ে চলতে হয় সেটা তার কাছে থেকেই শিখেছেন। আর কাবুলিরাও নাছোড়বান্দা-ঠিক বের করতো খুঁজে। আসল নয়,সুদ ঠিক মত দিতেই হবে । তবু ছবি করার স্বপ্ন । ছবি করার জন্য টাকা দেবার জন্য কাউকে রাজী করানোর জন্য কত পরিকল্পনা, কত প্রোগ্রাম । কিন্তু কখনও কাউকে এমন কোন দাবী বা পরিকল্পনার কথা বলতেন না যাতে তারা না বলে দেয়। সবসময় এমনভাবে বলতেন যেন সরাসরি না বলতে না পারে । একটা আশা যেন থাকে-ওই আশাই বাঁচিয়ে রাখতো । নইলে একবার না বলে দিলে আর থাকে কি।
একজায়গায় তিনি বলছেন “ দুঃখের দিনের সেইসব বন্ধুরা আজ কে কোথায় গেল । ঋত্বিক ,সলিলের সাথে বন্ধুত্বটা কিভাবে ভেঙ্গে গেল। একসময় জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলেন, কিন্তু ততদিনে দেখলেন আর সেই বন্ধুত্ব তেমনটি আর নেই। "বন্ধু যদি Contender হয় তবে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুস্কিল । এই কলকাতা শহরে একসাথে বাস করছি অথচ ঋত্বিকের সাথে যোগাযোগ নেই । ওর মেয়েকে দেখলে চিনতে পারবো না ,ভাবলেও দুঃখ হয়, কিন্তু এক্কেবার সত্যি।”(সেই সমহিতা ঘটকও ও আমাদের মধ্যে আর নেই)

 দেশভাগের আগে ও পরেও - হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় লড়েছেন। গরু খাওয়া তখনই শিখেছেন । কারণ সারারাত জেগে মুসলিম পাড়া পাহাড়া দিতে হয়েছে । খিদেও লাগত প্রচুর অথচ পকেটে পয়সা নেই । তখন সেই পাড়ারই ছোটখাট মুসলিম হোটেলে লোকেরা তাদের খাওয়াত,অল্প পয়সায় গরু ছাড়া আর কি! 
(প্রঙ্গত বলি, প্রবাদপ্রতীম শিল্প নির্দেশক খালেদ চৌধুরীও এই পাড়া পাহারাদারীর কাজ করতেন, তিনি আবার এককাঠি বারা, দিনে হিন্দু পাড়ায় পাজামা পড়ে কালী চৌধুরী নামে আর রাতে মুসলিম পাড়ায় লুঙ্গী পরে খালেদ নামে। অনেকেই হয়তো জানেন যে  বাংলা তথা ভারতীয় মঞ্চশিল্পের এই আশ্চর্য মানুষটির পিতৃদত্ত নাম চিররঞ্জন দত্তচৌধুরী। নাম বদলে নেওয়ার পিছনে রয়েছে এক প্রতিবাদী ইতিহাস। সে গল্প আর একদিন হবে)
                   খালেদ চৌধুরী

 হৃষিকেশ মুখার্জী ছিলেন দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মাইনে পাওয়া লােক। অ্যাসিস্টান্ট এডিটর হিসেবে ৬০ টাকা মাসিক মাইনেতে কাজ করতেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। দলের বাকীরা, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন তখন ছবিতে ঢােকার চেষ্টা চালাচ্ছেন আর রাজনীতি করে যাচ্ছেন। 
      রাজ কাপুর ও ঋষিকেশ মুখার্জী

 হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মণ, সলিল  চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মণ

    যুবা বয়সের তাপস সেন 

    ঋত্বিক ঘটক
 মৃণাল কোনদিনই কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন না, ঋত্বিক পরে মেম্বার হয়েছিলেন, এবং সদস্যপদ হারান'ও সেকথা অন্যত্র। মৃণাল মেম্বার ছিলেন না, পার্টি যখন এক ছিল তখনও না, যখন দুভাগ হল তখনও না। কিন্তু ওনাকে ওঁরা সকলে পার্টি মেম্বারের মতােই দেখতেন। ইংরেজ আমলে এবং কংগ্রেস আমলে যখন পার্টি আণ্ডারগ্রাউণ্ডে তখন উনি আণ্ডারগ্রাউণ্ড ওয়ার্কারের যেরকম কাজ বা দায়িত্ব ছিল সে ধরনের কাজও করেছেন। সেইসময় ওই
দায়িত্ববােধ থেকেই লেনিনের একথায় বিশ্বাস করতেন যে  “that of all the arts the most important for us is the cinema.” জোরের সঙ্গেই বিশ্বাস করতেন।
     ভ্লাদিমির লেনিন

 আসলে ফিল্ম তো একটা vehicle of expression, একটা instrument for social change। এ সম্পর্কে পরে কথা উঠতে পারে ফিল্ম কতখানি সােস্যাল চেঞ্জ করতে পারে, ম্যাজিকের মত কোন কিছু করতে পারে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
 তো সেই সময়ে কিন্তু ওঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ফিল্ম অনেক কিছু করতে পারে। এই তাগিদ থেকেই ওঁরা ফিল্মে ঢোকেন। সেখানে দুটো ব্যাপার মিশে গেল। মৃণালের বক্তবেই আছে " As a social being I need to express myself. I need to convey to others এবং সেইদিক থেকে want to sharemy own opinions with others or I want to provoke a controversy which is also very important। "

      মৃণাল সেন

 মৃণালের মনে হত সেখান থেকে ওঁরা একটা জায়গায় পৌঁছােতে পারেন। কিন্তু বললেই তো আর ছবিতে ঢুকতে পারা না! তখন ওঁরা একটা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলেন। সবাই মিলে ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির ভেতর একটা ট্রেড ইউনিয়ন করবেন অর্থাৎ চেষ্টা করছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন করে যদি ছবির মধ্যে ঢুকতে পারেন। 

    সেকালের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও - Photo courtesy Film Heritage Foundation.
 
 স্টুডিওতে ওয়ার্কাররা অসম্ভব কম টাকা পেত। ধারণা করা যায় না এত কম টাকা পেত সেখানে! অ্যাক্টররা কিংবা নামকরা ডিরেক্টররা যা মাইনে পেতেন, যা খেতেন, যা ট্রিটমেন্ট পেতেন, সাধারণ ওয়ার্কারদের সঙ্গে তার কোন তুলনাই হয় না। তো ওঁরা বিভিন্ন স্টুডিওতে এইসব বিষয় নিয়ে আলােচনা আরম্ভ করলেন, দাবী-দাওয়া পেশ করতে, সংঘবদ্ধ হতে। এভাবেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন। অর্থাৎ ওঁদের যা ইচ্ছে ছিল গেট ক্র্যাশ করা তাই।
 দুঃখের বিষয় হল সবাই যখন পায়ের তলায় কিছুটা মাটি খুঁজে পেলেন তখন যে বন্ধুত্ব নিজেদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল তা আস্তে আস্তে কিভাবে যেন ভেঙ্গে গেল। নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ খুবই কম হতে শুরু করল।যে ধরনের আলােচনা করতেন, একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার কথা ছিল সেটা আর হয়ে উঠল না।
    ১৬ এম এম মুভি ক্যামেরা, অ্যারিফ্লেক্স

 ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে ঢােকার আগে হৃষিকেশ মুখার্জী অত্যন্ত প্রাচীনএকটা 16 mm ক্যামেরা নিয়ে ছবি তােলার কথা ভাবতেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ইললিগ্যাল এবং আন্ডারগ্রাউণ্ডে। ওঁরা খবর পেলেন কাকদ্বীপ লাল এলাকা হয়ে গেছে,সব লাল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক করলেব ওখানে16mm ক্যামেরা নিয়ে ছবি করা হবে, জমির লড়াই বলে একটা স্ক্রিপট'ও করে ফেললেন। পরে অবশ্য সমস্যা হল ছবি প্রসেস করানাের ব্যাপারে এবং ছবিটি হয়ে উঠল না। কিন্তু যেটা বলছিলাম যে, ছবি করার তাগিদটা সমাজ পরিবর্তনের দিক থেকে ছিল এবং সেটা বেশ ভালা মাত্রায়ই ছিল।
     মৃণাল সেন, নাসিরুদ্দিন শাহ - খন্ডহর

 তো এভাবেই ছবিতে এসে পড়লেন মৃণাল সেন।
মৃণাল সেনের প্রথম ছবি রাতভোর ১৯৫৫, গ্রামের ছেলে  শহরে আসছে এবং সেখানকার সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে এক মর্মান্তিক মৃত্যুবরন করছে , অতি দুর্বল চিত্রনাট্য, উত্তম কুমার, সাবিত্রী, ছবি বিশ্বাসের মতন অভিনেতা থাকা সত্বেও সে ছবি চলেনি, কিন্তু যদি ছবিটা দেখে থাকেন তাহলে খেয়াল করে দেখবেন যে এই রাত ভোরের গল্পটাই কিন্তু মৃণাল সেন তাঁর পরের প্রায় সব কটি ছবিতেই নানা ভাবে বলতে চেয়েছেন, ঋত্বিকের যেমন বারবার দেশভাগের যন্ত্রনা ফিরে ফিরে এসেছে সেভাবেই মৃণাল সেনের ছবিতেও বার বার ফিরে এসেছে পরের ছবি গুলোতে তিনি যেভাবে ও যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় কথাটা বলতে পেরেছিলেন রাতভোরে হয়তো সেভাবে পারেননি কিন্তু এটা ঠিক হয়েই গেছিল যে তিনি কি বলবেন তাঁর ছবিতে। 
    
জসীমুদ্দিন তার ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ করার কথা একবার বলেছিলেন । মৃণাল সেন সেই ভেবে স্ক্রিপ্টও করেছিলেন অনেকটা । '‘৭১ তখনদেশ সবে স্বাধীন, চারদিকে একটা আলগা অবস্থা, আমি বাইরের মানুষ গিয়ে ছবি করব, কে কি ভাববে-ভয় ছিল । ব্যপারটা স্পর্শকাতরও ছিল । সেটা অমূলক না ।পরে শুনলাম অন্য কে একজন করছেন ,তাই আর সেটা হয়নি।”  মৃণালের বক্তব্য হচ্ছে যে “এমন ছবি বানাতে হবে যেন সবাই দেখে-কিন্তু কোন কম্প্রোমাইজ নয় শিল্পের সাথে,নীতির সাথে। ছবি তো শুধু গুটি কতক দর্শকের জন্য ছবি নয়, যত বেশি লোক দেখবে তত বেশি তার সার্থকতা । তবে ওই কখনও আপোষ করে নয় সিনেমা আলাদা কোন শিল্প নয়,বরং বলা যায় এটি সব শিল্পের সমন্বয়।”  

সিনেমা সবচেয়ে পরে এসেছে তাই ওর মধ্যে সব শিল্পের একটা সমন্বয় হয়েছে ,বার্গম্যান একদিকে ছবি করেছেন,অন্যদিকে নাটক । মাঝখানে দেয়াল নয় -একাট অর্গল রেখেছেন । অন্য সব শিল্পকে আত্মস্থ করতে হবে । বাইসাইকেল থিফ’দেখে আদ্রে জিদ চিঠি দিয়েছিলেন তার মধ্য শিল্পসুষমা ও মাধ্যমে সমন্বয় দেখে। আইজেনষ্টাইন নিজেও ছিলেন তেমনি একাধিক শিল্পের অধিকারী-বিশ্বের একনম্বর পরিচালক।  

 আর তাই দেখি মৃণাল সেন তাঁর ছবিতে এনে ফেলেন ফ্রিজ ফ্রেম, জাম্প কাট, ডাইরেক্ট পেইন্টিং নিউজ রিডিং ইত্যাদি বস্তু যেগুলি তৎকালীন বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায় নতুন জিনিষ। চিত্রগ্রাহক কে কে মহাজন কে ১০ তলা বাড়ীর কার্নিশে তুলে নিজে তাঁর কোমর জাপটে রেখে শ্যুট করিয়েছেন, ঠিক এই জিনিষ গোদার আর রাউল কুতারের ক্ষেত্রে আমরা পাই। বলতে দ্বিধা নেই গোদারের আগেই বা সমসময়েই এইসব নতুন জিনিষ দিয়ে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করেছিলেন মৃণাল সেন। তাই পশ্চিমের গোদার আর আমাদের মৃণালের মুখে প্রায় একই কথা “ছবি বানাতে অনেক পয়সা লাগে বলে যারা ভয় পাইয়ে দেয়, তারা মিথ্যে বলে ।পয়সা লাগে যদি লাগাতে চাও। কম পয়সায়ও ছবি বানান যায়- এবং তা ভালো ছবিও” ।
     মৃণাল সেন ও কে কে মহাজন

    জঁ লুক গোদার ও রাউল কুতার

 চার্লি চ্যাপলিন কে নিয়ে তাঁর ছিল বিশেষ অনুরাগ, তাঁর তৈরী আকাশ কুসুম ছবিতে দেখবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে গান আছে “তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই” তাঁর মনে পড়ে যায় গোল্ডরাশ ছবির কথা, ১৯৫৩ বা ৫৪ তে চ্যাপলিন কে নিয়ে তিনি লেখেন একটি বই যার নাম ছিল 'এই যে আমি চার্লি চ্যাপলিন' পরে সে নাম পালটে হয় শুধু  'চার্লি চ্যাপলিন' কিছু বছর আগে নিউ এজ থেকে সে বই আবার বেড়িয়েছে এবং সাথে আরো কিছু লেখা যুক্ত হয়ে যার নাম হয়েছে “চ্যাপলিন নামা’’। 
 মার্কেজ সিনেমা বানাতে বলেছিলেন মৃণাল সেনকে। হ্যাঁ লাতিন আমেরিকার অবিসংবাদিত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তিনি চাইতেন না তার লেখা নিয়ে কেউ ছবি করুক। তবে ভারতের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনকে তিনি তার ‘অটম অব দ্য প্যার্টিয়ার্ক’ নিয়ে ছবি বানানোর অনুরোধ করেছিলেন। এ জন্য তিনি কোনো অর্থও নেবেন না বলেছিলেন। কিন্তু মৃণাল সেন এ ব্যাপারে তার অপারগতার কথা সরাসরি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

 এ ব্যাপারে মৃণাল সেনের বক্তব্য ছিল, '‘আসলে তিনি (মার্কেজ) একটা ভারতীয় কানেকশন খুঁজছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে ওই গল্প নিয়ে ছবি বানানো সম্ভব ছিল না। ভারতীয় বাড়ির ছবি থেকে গল্পটি ওর মাথায় এলেও পুরোটাই ভীষণ রকম লাতিন।’' মার্কেজ জানিয়েছিলেন, ছোটদের কোনো একটা বইতে তিনি একটা ভারতীয় বাড়ির ছবি দেখেছিলেন। সেই ছবিটিকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন গল্পটি।
মৃণাল সেন মার্কেজকে বলেছিলেন, গল্পে সমাজ থেকে শুরু করে আদব-কায়দা সবই লাতিন আমেরিকার আদলে। ফলে সেটিকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। মার্কেজ কথাটা মেনে নিয়েছিলেন। মার্কেজ নিজেও চাইতেন না তার লেখা নিয়ে কোনো সিনেমা তৈরি হোক। কথাটা তিনি হাভানায় বসে মৃণাল সেনের সঙ্গে এক আড্ডায় বলেছিলেন। মার্কেজ মনে করতেন, ওর গল্পের যা গঠন তা থেকে ছবি করা মুশকিল। গল্পের মূল চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
    গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও মৃণাল সেন

 মার্কেজের মৃত্যুর পর তার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে মৃণাল সেন জানান, ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে মার্কেজও ছিলেন জুরি হিসেবে। সেখানে প্রথম দেখা হলেও সেই আলাপ দ্রুত বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। এর দু-তিন বছর পরে হাভানাতেই মার্কেজের সঙ্গে অনেক আড্ডা হয়েছে। সাহিত্য থেকে কীভাবে ছবি বানানো যায়, তা নিয়েও অনেক আলোচনা করেছিলেন তিনি মার্কেজের সঙ্গে। ওপরের এই আলোচনা থেকেই অনুমান সম্ভব মৃণাল সেন কোন মাপের চলচ্চিত্র নির্মাতা।

এটুকুই থাক আজ, প্রায় ৬০ বছরের চলচ্চিত্র-সংগ্রামের ইতিহাস এত স্বল্প পরিসরে হাজির করা সম্ভব নয়। মৃণাল সেনের কোনো ছবি নিয়েই আমরা আজ কথা বললাম না। শতবর্ষে আমরা চেষ্টা করব সেসব নিয়ে কিছু বলার।

লেখ সূত্র
১- নন্দন প্রেক্ষাগৃহে সিনেসেন্ট্রাল-চিত্রবীক্ষন পত্রিকা আয়োজিত এক সভায় দেওয়া সাক্ষাৎকার pp.9

২- V. I. Lenin, Collected Works (New York: International Publishers, 1934), Vol. XLII, pp. 388-389.

লেখার কোনোও কপিরাইট নেই, লেখকের নাম সহ বা নাম ব্যাতিরেক যে কেহই ইহা অবাণিজ্যিক ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করিতে পারেন।

Labels:

Wednesday, May 11, 2022

নাছোড়বান্দা স্মৃতিসমূহ - তমাল বোস



মে বড় ঝামেলার মাস, একে তো প্রথম দিনেই শ্রমিক দিবস তারপর সারা মাস জুড়ে প্রতিভাবানদের আনা-গোনা, আজ তিন তিনজনের আবির্ভাব, সালভাদোর দালি, রিচার্ড ফাইনম্যান, সাদাত হাসান মাণ্টো।

নাছোড়বান্দা স্মৃতিসমূহ

১৯০৪ সালের ১১মে সালভাদোর দালি জন্মগ্রহন করেন, তাঁর আঁকা সম্ভবত সবচাইতে বিখ্যাত ছবি হচ্ছে দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরী, (1931- Oil on canvas - 24 cm × 33 cm (9.5 in × 13 in) , Museum of Modern Art, New York City ) তো এই ছবির একটা ইটালিয়ানপ্রিন্ট আমাদের আগের কাজের জায়গায় ছিল রয়েছে, আর ছবিটা মধ্যে মধ্যেই  বিড়ম্বনায় ফেলত যখন কেউ জিজ্ঞেস করেন “ এটার মানে কি?” ছবির মানে করা হলো একটা অসম্ভব আপেক্ষিক কাজ। এক আমরা স্রষ্টা ও ছবি বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়ে মানে বুঝতে পারি অথবা নিজেরা নিজেদের জানা বোঝা ব্যাবহার করে একটা মানে বের করতে পারি আর পারি দুটোকে মিলিয়ে একটা কিছু দাঁড় করাতে, এখানে সেই চেষ্টাই হয়েছে।
    দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেকদিন হলো আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে আর কিছুদিনপরেই, ইওরোপ কাপাচ্ছে তিনজন একনায়ক হিটলার, মুসোলিনি আর ফ্রাঙ্কো। জাত্যাভিমান, জাতিয়তাবাদ আর ইহুদিবিদ্বেষ আসল উদ্দেশ্য সমাজবাদী সাম্যবাদী সোভিয়েতের শ্রেনীর লড়াইকে ধংস করা, এদের পেছন থেকে মদত দিচ্ছে আরোসবসাম্রাজ্যবাদী দেশ। লেখক শিল্পী বিজ্ঞানীরা সব দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন নয়তো মেরে দেওয়া হচ্ছে। আর এই সময়েই আমাদের স্ববর্নিত প্রতিভা সালভাদর দালি ভাবছেন তাঁর “নমনীয় ও শক্ত বস্তু নিয়ে”।

হাতে তেমন কাজ কম্ম নেই, ছবি আসছে না মাথায় এবং খানিকটা দারিদ্রতার সমস্যা। সেদিন স্ত্রী গালা আর সব সুররিয়াল শিবিরের বন্ধুদের সাথে গেছেন সিনেমা দেখতে, খাওয়া দাওয়া সেরে অনেক রাতে বাড়ী পৌছে দেখেন ঘরটর সব অন্ধকার, গাউন পরা দালির চোখমুখ অসম্ভব উজ্জ্বল। টান মেরে তাকে কাজের ঘরে নিয়ে গেলেন দালি, একটা ক্যানভাস কাপড় দিয়ে ঢাকা, ঢাকা সরাতেই ... দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরী।সেই গলে যাওয়া ঘড়ির ছবি, দালি বলতে অনেকেই যা বোঝেন।

 পকেট ঘড়িগুলো গলে নেতিয়ে পড়ছে যা কিনা শিল্পীর অবচেতনে থাকা স্থান ও কালের আপেক্ষিকতার প্রতীক, আমাদের মহাজাগতিক নিয়মানুবর্তিতারপরাবাস্তবিক প্রেরনা। দালি তাঁর ডায়েরিতে বলছেন “ এছবির ভিত্তিপ্রস্তর সূচিত হয় খাওয়ার টেবিলে”, গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে ক্যামোবের চীজের গলে যাওয়াদেখে তাঁর মনে হয়েছিল, সময়ও তো এভাবেই গলেযায় রুপান্তরিত হয় আর সেটা চোখে দেখা যায়না, কিন্তু তার ধাবমানতা বোঝা যায়। সময়ের অস্থিরতাকে বোঝাতেই তাঁর ঘড়িরা গলে পড়ে। এবং অবচেতন স্তর থেকেই এছবিতে দালি বুঝতে ও সংযুক্ত করতে চেয়েছেন আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটিকে। 

ছবির মধ্যে আমরা পাই দালির বিমুর্ত আত্মপ্রতিকৃতি যেটা উনি অনেকবার অনেক কাজের মধ্যেই এনে ফেলেছেন, এখানে সেটি একটি হয়ে ওঠা মাছ, যা কিনা সম্পুর্ন রুপ পাবে তাঁর এই সিরিজের পরের ছবি দ্য ডিসইন্টিগ্রেশন অব দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমরী’তে, সেখানে মাছ আসবে সব পারমানবিক ধংসলীলার শেষে জীবনেরপ্রতীক রুপে। 

এইছবির বিমুর্ত আত্মপ্রতিকৃতির চোখে অনেক অক্ষিপল্লব লক্ষ করা যায়, কেন? ভাববাদী দালি ও তাঁর স্বপ্নে পাওয়া বস্তুর নিরিখে ব্যাপারটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং একটা স্বপ্নের স্তরে রয়েছেন এবং সেটা দালি নাকি সেটাও স্বপ্নে দেখেছেন, বোঝো কান্ড। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (ইনিও মে) ইন্টারপ্রেটেশন অব ড্রিম তিনি নিজের মত করে নিয়ে কাজ করে গেছেন, আর স্বয়ং ফ্রয়েড বলছেন দালির মত একগুয়ে স্প্যানিয়ার্ড তিনি নাকি আর একটিও দেখেননি। 

যাই হোক, এছবিতে আমরা আর একটা কমলারঙা ঘড়ি দেখি যার মধ্যে বহু কালো পিঁপড়ে খুবলে খাচ্ছে, এই সেই পিপড়ের দল, যা কিনা দালির কাছে ক্ষয়ের প্রতীক। তবে দালির কথা ধার করেই বলাযায় যে অবচেতনে রয়ে যাওয়া সৌরকলংকের একটি মূর্ত ধারনা এটি। আর ছবিতে যে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী পরিলক্ষিত হচ্ছে তা একেবারেই তাঁর একান্ত প্রিয় ছুটি কাটানোর জায়গা কাটালনিয়ায় বসবাসকালিন ইমেজারি, বহু ছবিতে এই নৈসর্গ তিনি এনেছেন।

এই সিরিজের পরের ছবি দ্য ডিসইন্টিগ্রেশনঅব দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমরী - যেখানে পদার্থবিদ্যার আরেক ধারা কোয়ান্টাম মেকানিকস (Feynman- may
) পরাবাস্তববাদী ধারনা পাবো।  

    রিচার্ড ফাইনম্যান

ফাইনম্যান কে? 

"সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভালোবাসা।"
ছোটবেলায় নষ্ট রেডিও সারতে ওস্তাদ হয়ে ওঠে ছেলেটি। দস্যি ছেলের কিশোর বয়সে ক্যালকুলাসে দক্ষতা স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রিয় করে তোলে। এই ছেলেই বিশ শতকের অন্যতম পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যান। 

১৯১৮ সালে জন্ম নেওয়া মার্কিন বিজ্ঞানী ফাইনম্যানের গবেষণার ক্ষেত্র ছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও কণা পদার্থবিজ্ঞান। তিনি এমআইটি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি সর্বকনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে পারমাণবিক বোমা তৈরির ম্যানহাটন প্রজেক্টে অংশ নেন। 

১৯৪৫ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৫০ সালে ক্যালটেকে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস ও অত্যধিক শীতল তরল হিলিয়ামের কণাপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ সময় অতিপারমাণবিক কণার আচরণ বিশ্লেষণের ওপর একটি ডায়াগ্রাম প্রকাশ করেন, যা পরে ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়। 

"বিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এটি জীবন্ত।"

ফাইনম্যানের ছিল পেল্লাই এক ম্যাক্সিভ্যান গাড়ী, যার সারা গায়ে ফাইনম্যান ডায়াগ্রামস আকা ছিল, কেউ সেটা কেন আছে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসতো " কারন আমি ফাইনম্যান" ২০১৪ সম্ভবত বিজ্ঞানীদের ভোটে " জনপ্রিয়তম বিজ্ঞানীর লিস্টে সপ্তম" হন ফাইনম্যান গ্যালিলিওর ঠিক পরেই। 

"প্রকৃতিকে জানতে হলে, তার সৌন্দর্যকে অনুধাবন করতে হলে প্রকৃতির ভাষা জানা চাই।" পদার্থবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব সবাই যেন সহজেই বুঝতে পারে, সে জন্য সহজ ভাষায় তিনি লেকচার দিতেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ‘দ্য গ্রেট এক্সপ্লেনার’ হিসেবে খ্যাতি পান। ‘দেয়ারস প্লেনটি অব রুম অ্যাট দ্য বটম’ নামের বিখ্যাত লেকচারে ন্যানোটেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা দেন।

তার কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস ও দ্য থিওরি অব ফান্ডামেন্টাল প্রসেসেস নামের দুটি বিখ্যাত বক্তব্যসমগ্র রয়েছে। ১৯৬৫ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি কোয়ান্টাম কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। 

"সব মৌলিক প্রক্রিয়াকেই উল্টোদিকে চালনা করা সম্ভব।" এই পদার্থবিজ্ঞানী Anticlock নামের চলচ্চিত্রে অধ্যাপক হিসেবে অভিনয় করেন। গবেষক পরিচয় ছাড়াও তিনি শিওরলি ইউ আর জোকিং, মি ফাইনম্যান! ও হোয়াট ডু ইউ কেয়ার হোয়াট আদার পিপল থিংক ( Ralph Leighton) নামের রম্য বইয়ের জন্য বিখ্যাত।

তিনি নভোখেয়া চ্যালেঞ্জার ধ্বংসের কারণ অনুসন্ধানের রজারস কমিশনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। "দুবার মরতে হলে ব্যাপারটাকে আমি ঘৃণা করতাম। কারণ মৃত্যু খুবই একঘেয়ে ব্যাপার।" তিনি একজন স্পেশালিষ্ট বঙ্গো বাদকও বটেন।

১৯৮৮ সালে লিপোসারকোমা ও ম্যাক্রোগ্লুবুলিনেমিয়া নামের দুরারোগ্য ক্যানসারে মারা যান এই বিজ্ঞানী।
"যা আমি তৈরি করতে পারি না, তা আমি বুঝি না।" (মৃত্যুর পর তাঁর চকবোর্ড থেকে নেয়া হয়েছে।)

    সাদাত হাসান মান্টো

মৃত্যুর কথায় মনে পড়ল মান্টোকে।

উর্দু কথাসাহিত্যের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সাদাত হাসান মান্টো। জন্ম—১৯১২ সালের ১১ই মে পাঞ্জাবের লুধিয়ানার সোমরালা গ্রামে।   দেশ বিভাগের দাঙ্গা ও পতিতাদের নিয়ে লিখেছেন কিছু অসাধারণ গল্প। বুর্জোয়া সমাজের সকল ভণ্ডামি এবং অপকর্মের বিরুদ্ধে মান্টো সারা জীবন লড়াই করেছেন, অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু নতি স্বীকার করেননি।

মান্টো ব্রিটিশ আমলে ‘বু’, ‘কাল সালোয়ার’ প্রভৃতি গল্পের জন্য যেমন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন তেমনি পাকিস্তান আমলেও ‘ঠান্ডা গোশত’, ‘খুলে দাও’, ‘উপর, নিচে ও মাঝে’ গল্পগুলির জন্য দেশের মূল্যবোধের বিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত হন। দুই আমলেই আইনের ধারা ২৯২। 

মান্টোর ইংরেজি  অনুবাদক খালিদ হাসান বলেছেন, ‘মান্টো শুধু আমাদের দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের নয়, সারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লেখকদের একজন।’ একথা ষোল আনা সত্য।

মান্টোর লেখালেখির জীবন দুই দশকের। এসময় লিখেছেন ২২টি গল্পগ্রন্থ, ৫টি বেতার নাটক ও একটি উপন্যাস। তাঁর লেখালেখির জীবন ও সমকালীন উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্রমপঞ্জি মিলিয়ে দেখা যাবে, তিনি ব্রিটিশ শাসনের চূড়ান্ত পর্যায়, দেশভাগ ও উপনিবেশ-উত্তর পাকিস্তানের মূলধারার ইতিহাসের এক অস্বস্তিকর সাক্ষী। তাঁর নির্মম সমালোচনায় ঝুড় ঝুড় করে ভেঙ্গে পড়ে সমাজের কৃত্রিম জাঁকজমক।

১৯৩৪ সালের আগস্টে লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘খালক’ নামক সাহিত্য পত্রিকায় মান্টোর প্রথম গল্প ‘তামাশা’ ছাপা হয়। গল্পের বিষয়বস্তু সাত বছরের এক বালকের চোখে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড।

জালিয়ানওয়ালাবাগের সভাকে কেন্দ্র করে যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল তার কারণ জিজ্ঞাসিলে খালেদ নামক বালকের পিতা বলেন একটা তামাশা হতে যাচ্ছে। খালেদ আকাশে দেখে চিল চক্রাকারে উড়ছে, প্লেনের পেট থেকে বোমের ডিম পারার গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হয়। বাবা খালেদকে তামাশা দেখতে নিয়ে যাবেন এই আশ্বাস দেন। যথারীতি ঘটনার দিন খালেদের উৎসাহ নিবৃত্তিতে বাবা বারবার বলেন তামাশার এখনো অনেক বাকি, সবুর কর বেটা। খালেদ দোতলার জানলা থেকে মাঠের দিকে তাকিয়ে থেকে, আর গুলির শব্দে চমকিত হয়, ভাবে তামাশা শুরু হয়ে গেছে, বাবা কেন এখনো রওনা দেন না! একটা তীক্ষ্ণ ক্ষীণ আর্তচিৎকার ক্রমশ দ্রুতলয়ে বিকট হয়ে ওঠে। সে দেখে একটি ছেলে দৌড়ে পালাচ্ছে। তার পায়ের জখম থেকে ঝড় ঝড় করে রক্ত ঝড়ছে। ছেলেটি খালেদের বাড়ির সামনে লুটিয়ে পড়ে, জ্ঞান হারায়। খালেদ দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে বলে ছেলেটিকে বাঁচাতে। বাবা অজানা এক গম্ভীরতায় নিশ্চুপ  থাকেন। খালেদ মার কাছে ছুটে যায়। মা, ছেলেটির কি হয়েছে? মা বলেন, দুষ্টুমি করায় শিক্ষক মেরেছেন। খালেদের পাল্টা প্রশ্ন, কই শিক্ষক মারলে তো রক্ত ঝড়ে না! ছেলেটির বাবার উচিত শিক্ষককে ভাল করে বকে দেওয়া। মা বলেন এই শিক্ষক ছেলের বাবার চেয়ে অনেক বড়, কিছু বলা যাবে না। আল্লাহর চেয়েও কি বড়? খালেদের মা বলেন, না তা নয়। তবে আল্লাহর কাছেই ছেলের বাবার নালিশ দেওয়া  উচিত বলে খালেদ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। তার মনে একটি প্রশ্ন রয়েই যায়, মানুষকে গ্রেপ্তারের জন্য এত পুলিশ ভ্যান আছে কিন্তু এই মৃতপ্রায় ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় জন্য কোন যানবাহন নেই কেন? সাত বছরের এই বালকের প্রশ্নের মুখে আমাদের চুপ করে থাকতে বাধ্য করেন মাণ্টো তার আরো অনেকানেক কাজের মত যথা খোল দো, ঠান্ডা গোস্ত, বু, নয়া কানুন, কাল সালওয়ার ইত্যাদি। 

কৃষণ চন্দর মান্টোর সাথে আড্ডার স্মৃতি নিয়ে বলেছিলেন, আপনি যদি জিন্নাহ বা গান্ধির প্রশংসা করেন তাহলে সে পাড়ার মুচির ব্যক্তিত্বের মহিমা গাইবে।

মান্টো ১৯৫১-৫২ সালে দুবার পাগলা গারদে ছিলেন।

১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। আগেরদিন এক বীভৎস গল্প শুনে সারাদিন মদ খেয়ে কাটিয়েছেন মান্টো।সকাল দশটার দিকে হঠাৎ তীব্র খিচুনি শুরু হয়। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আসে। দরজায় অ্যাম্বুলেন্স দাড়িয়ে, ব্যথায় কোঁকড়ানো, তবু একটু মদ চাইলেন। তার মুখে এক চামচ হুইস্কি ঢেলে দেওয়া হয়। এক বিন্দু অতি কষ্টে গলার ভিতর প্রবেশ করেছে। অবশিষ্ট মদ মুখের বাইরে পড়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মান্টো অ্যাম্বুলেন্সে মারা যান।  ৪২ বছরের এক চামচ জীবন ফুরিয়ে যায়।

ঋণ - "Dali, The Flamboyant Surrealist", MoMa, প্রথম আলো আর্কাইভ, পথিক গুহ, জন গ্রিবিন, অ্যালেন স্টিভেন, আয়েশা জালাল,আবিদ হুসেইন।

লেখার কোনোও কপিরাইট নেই, লেখকের নাম সহ বা নাম ব্যাতিরেক যে কেহই ইহা অবাণিজ্যিক ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করিতে পারেন।

Labels: , ,

Saturday, May 7, 2022

পিয়্যতর চায়কভস্কির সোয়ান লেক ও ১৮১২ ওভার্চার - তমাল বোস

সে অনেক আগের কথা

৭ই মার্চ ১৮২৪,  মারা যাওয়ার তিন বছর আগে ল্যুদভিগ ফন বেটোফেনের নবম সিম্ফনি আমজনতার জন্য বেজে উঠলো অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। ৭মার্চেই ৭ বছরের ব্যাবধানে জন্মালেই দুই দিকপাল সংগীত রচয়িতা।

লুদভ্যিগ ফন বেটোফেন ও পিয়্যতর চায়কভস্কি


১৬ বছর পর সেই বাজনার রেশ কী পৌঁছেছিলো রুশ দেশের উদমুর্শিয়া অঞ্চলের ভৎকিনসক নামক ছোট্ট শহরে! 

তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে  এক চিঠিতে চেখভ লিখেছিলেন – “আমি পিয়্যতর চায়কভস্কির বাড়ি দিবারাত্র পাহারা দিতে পারি, এতটাই আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
   চায়কভকস্কি প্রসংগে চেখভ

১৮৪০ সনে ভৎকিনসক শহরে জন্মানো 
চায়কভস্কি তাঁর কৈশোরে পুরোপুরি ঝুঁকে ছিলেন মোৎসার্টের দিকে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তিনি বেটোফেনে সরে আসেন। বেটোফেন প্রসংগে তিনি বলেন 'লিওনোরে ওভার্চার নং৩ এর মত বিশাল ব্যাপ্তির সিম্ফনিক ম্যুজিক হয়ত আর লেখা হবেনা।' মিকেলেঞ্জেলোর কাজের বিশালত্বের সাথে তিনি বেটোফেনের তুলনা করতেন। 

যেটা বলার, ৭টি সিম্ফনি, ১১টি অপেরা, ৩টি ব্যালে, ৫টি সুইট, ৩টি পিয়ানো কনচের্তো, ১টি ভায়োলিন কনচের্তো, ১১টি ওভার্চার, ৪টি কান্তাতা, ২০টি কোরাল সংগীত, ৩টি স্ট্রিং কোয়ার্টেট, ১টি স্ট্রিং সেক্সটেট এবং ১০০রও বেশি গান ও পিয়ানোবাদন-যন্ত্রসংগীতের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ' সোয়ান লেক'... পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম ব্যালে যাতে আরো বেশী প্রাণ ঢেলে, আরো জনপ্রিয় করেছে 'বলশয় ব্যালে'। দ্য নাটক্রাকার বা দ্য স্লিপিং বিউটিও প্রসিদ্ধ তবে এতটা জনপ্রিয় নয়।

চায়কভস্কি ও বলশয় ব্যালে প্রনীত সোয়ান লেক

আলো -অন্ধকারের রেষারেষি নিয়ে ১৮৭৫ সালে তিনি রচনা করেন সুরেলা রূপকথা ‘সোয়ান লেক’৷ ১৮৭৭ সালে একে প্রথম মঞ্চে নিয়ে আসে রুশ দেশের বলশয় ব্যালে৷ 

এক যুবরাজ সিগফ্রিদ ও ওদেতের গল্প। মায়ের ইচ্ছা ছেলে এবারে বিয়ে করে ফেলুক। যুবরাজ শুনলেন ঐ দূরে যে রাজহাঁসেদের হ্রদ! সেখানে শয়তান যাদুকর রথবার্ত সব মেয়েদের রাজহাঁস বানিয়ে রেখেছে। তারা দিনে রাজহাঁস আর রাতে নারী। রাজকুমার সেই লেকের উদ্দেশে রওনা হলেন৷ লেকে পৌঁছে দেখলেন সেখানে অনেক রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ একটির দিকে তির -ধনুক তাক করতেইসেটি রূপান্তরিত হল এক পরমাসুন্দরী কন্যায়৷ তাকে দেখা মাত্র রাজকুমার প্রেমে পড়লেন৷ কন্যা জানাল, তার নাম ওদেত৷ কোনও পুরুষ যদি ওদেতকে চিরকালীন প্রেমের প্রতিশ্রুতি দেয় তবেই সে ও তার সখিরা শাপমুক্ত হবে৷ অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর, রাজকুমার সিগফ্রিড রথবার্টকে পরাজিত করেন৷ ওদেত ও তাঁর সখিরা ফিরে পান মানবজমিন৷ সিগফ্রিড ও ওদেতের শুভ পরিণয় দিয়ে গল্প শেষ৷ 

তো সেই মহান রুশ সংগীত রচয়িতা পিয়্যতর ইলিচ চায়কভস্কি আজ ১৮১তে।

নিকোলাই দিমিত্রিয়েভিচ কুঝনেৎসভের তুলিতে চায়কভকস্কি

তবে সোয়ান লেক নয়, আজ অন্য একটা জিনিস শোনাতে চাই। ঐ ১১টি ওভার্চারের মধ্যে যেটি জেমস ম্যাকতেগু তার ভি ফর ভেনদেত্তা ছবিতে ব্যবহার করেছেন সেই ১৮১২ নং ওভার্চারটি৷ এটি নিয়ে বিষদে আমরা পরে লিখবো৷ নাপোলিয়ঁ বোনাপার্টের রুশিয়া আক্রমন কে রুখে দেওয়ার কাহিনী যেখানে 'লা মার্সাই'ও রয়েছে। চায়কভস্কির সময়কার রুশ জাতীয় সংগীত 'গড সেভ দ্য ৎসার' রয়েছে এবং আরো কিছু এনালিসিস৷ সে সব অন্যদিন। আজ কেবল শুনুন আর বেটোফেনের নবম সিম্ফনির খোঁজ করুন এর মধ্যে। 
https://youtu.be/KYyK6UjWQTU

★পড়ার জন্য ধন্যবাদ। কোনোও কপিরাইট নেই, যে কেউ লেখকের নামোল্লেখ করে বা না করেও ব্যবহার করতে পারেন। 

Labels: , ,

Thursday, May 5, 2016

কার্ল মার্ক্স বিষয়ে দু একটি কথা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত বৃটিশ বিরোধী ভারতীয় সিপাহী ও কৃষক জনতার বিপ্লবী যুদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মহামতি কার্ল মার্কস এই মহান বিদ্রোহকে “ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। “ব্রিটিশ শাসক শ্রেণিরা অভ্যূত্থানকে কেবল সিপাহীবিদ্রোহ রূপে দেখাতে চায় তার সাথে যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক অংশ জড়িত তা লুকাতে চায় তারা।” (প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ: কার্ল মার্কস- ফ্রেডারিক এঙ্গেলস পৃষ্ঠা ১০)
কার্ল মার্ক্স

১৮১৮ সালের ৫ই মে তৎকালীন প্রাশিয়ার ত্রিভস (ত্রিয়ের) শহরেকার্ল মার্ক্স জন্মগ্রহণ করেন। মার্কসরা ছিলেন সমৃদ্ধশালী এবং সংস্কৃতিবান। তাঁর বাবা হার্শেল মার্ক্স পেশায় ছিলেন একজন অ্যাডভোকেট। শুরুতে ইহুদি ধর্মাবলম্বী হলেও, বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে তিনি সন্তান জন্মাবার আগেই প্রটেস্টান্ট (খ্রিষ্ট) ধর্মে দীক্ষিত হন। ছোট থেকেই কার্ল মার্ক্স ভালো ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি। প্রেমিকা জেনি ভন ভেস্তফালেন-কে নিয়ে লেখা প্রেমের কবিতাগুলো  সে সবের সাক্ষ্য বহন করে তাছাড়া তিনি "স্করপিয়ন আন্ড ফেলিক্স  Scorpion and Felix  নামক একটি উপন্যাস ও Oulanem নাটক  লেখেন।
কার্ল মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর University of Bonn-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্ক্স জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুন হেগেলিয়ান Young Hegelians দের  নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature" (প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য)। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র‌্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিল না।
হেগেল

ফয়েরবাখ
বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ভাগ ছিল। তরুণ হেগেলিয়ান, দার্শনিক ছাত্র এবং লুদউইগ ফয়েরবাখ Ludwig Feuerbach  ব্রুনো বাউয়ের Bruno Bauer,-কে কেন্দ্র করে গঠিত সাংবাদিক সমাজ ছিল বামপন্থী। আর শিক্ষক সমাজ ছিল জি ডব্লিউ এফ হেগেল G. W. F. Hegel এই দুটি ভাগ ছিল পরস্পরবিরোধী। হেগেলের অধিবিদ্যাগত অনুমিতিগুলোর সমালোচনা করলেও বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রাজনীতির কঠোর সমালোচনার জন্য হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতো। 
হেগেল সব কিছু পর্যবেক্ষন করে যেটা শেষমেশ দাঁড় করালেন তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘absolute idea’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। তিনি যেটা ধরে নিয়েছেন তা হচ্ছে আইডিয়া হল ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। কিন্তু তার মধ্যে স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব আছে, এবং সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাস্তব জগতের সৃষ্টি। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, বাস্তব জগৎটা হচ্ছে একটা ছবি এবং সেই অর্থে সেটা হল ‘absolute idea’ এর প্রকাশ । অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে তা সেই absolute idea এরই বহিঃপ্রকাশ। এই কারনে হেগেলরই কিছু ছাত্র যাদের বলা হত বাম-ঘেঁষা (Left Hegelian), তাঁরা তাঁদের শিক্ষকের ‘অরিজিনাল আইডিয়া’ কে মানতে রাজী হল না। এর মাঝে ফুয়েরবার্খ, মার্ক্স অন্যতম। তাঁরা যেটা বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত।
কিছু তরুণ হেগেলিয়ান এরিস্টটল-উত্তর দর্শনের সাথে হেগেল-উত্তর দর্শনের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যেমন, ম্যাক্স স্তির্নার তার Der Einzige und sein Eigenthum(১৮৪৪) বইয়ে ফয়ারবাখ ও বাউয়ারের সমালোচনা করেন, বিমূর্ত ধারণাগুলোর দ্ব্যর্থতাবোধক হেত্বাভাস (reification) চর্চার জন্য তাদেরকে ধার্মিক ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। মার্ক্স এই বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে ফয়ারবাখের বস্তুবাদ ত্যাগ করেন। এই রূপতাত্ত্বিক বিরতি (epistemological break)   ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে তার ধারণার ভিত্তি রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করে।
বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের পাঠ সমাপ্ত করে মার্ক্স যোগ দেন রাইনল্যান্ডের র‍্যাডিকাল যুবকদের দ্বারা পরিচালিত ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদপত্র’ (Rheinische Zeitung) নামক পত্রিকায়। ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি এর সম্পাদক হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই মার্কস-এর ক্ষুরধার লেখনীর জোড়ে কাগজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে সরকার বাহাদুর যারপরনাই বিরক্ত হন। কয়েক মাসের মধ্যেই কাগজের অফিসে তালা পড়ে যায়। এই সময় মার্ক্স অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেয়া শুরু করেন।
কার্ল ও জেনি

 ১৮৪৩ সালের ১৯-এ জুন জেনির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন কার্ল। জেনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যারনের কন্যা। এর পর তাঁরা চলে আসেন পারী শহরে। ১৯৪৩শেই জর্মন সমাজতন্ত্রী Arnold Ruge এর সাথে জর্মন এবং ফরাসী র‍্যাডিকালদের একত্রীকরনের কাজ শুরু করেন এবং সহ সম্পাদক হিসেবে  Deutsch-Französische Jahrbücher (German-French Annals)- এ কাজ নেন।
পারী শহর ১৮৪৩

পারী শহর থেকেই শুরু হয় অপরিসীম দারিদ্র্য ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তির প্রবল বাধার মুখে দাঁড়িয়ে তাঁদের লড়াই, যা জীবনের শেষ দিন অবধি ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। 
মার্ক্স ও এঙ্গেলস

এই সংগ্রামে মার্ক্স এবং জেনির পাশে এসে দাঁড়ান তাঁদের অকৃত্রিম বন্ধু কমরেড ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস Friedrich Engels ২৮শে আগষ্ট ১৯৪৪ তাদের প্রথম সাক্ষাত Café de la Régence তে। এঙ্গেলস তাঁর  The Condition of the Working Class in England বইটি মার্ক্সকে দেখান এবং মার্ক্স  অবিভুত হন। মার্ক্সের পুরনো দোস্ত Bruno Bauer এর দার্শনিক চিন্তাভাবনা'কে সমালোচনা করে তিনি ও এঙ্গেলস রচনা সমাপ্ত করেন যা কিনা পবিত্র পরিবার The Holy Family নামে প্রকাশিত হয় । ১৮৪৫ সালে প্রাশিয়ান সরকারের বদমায়েশির ফলে ্মার্ক্স-কে তাঁর পরিবার-সমেত প্যারিস থেকে নির্বাসিত করা হয়। তাঁরা চলে যান ব্রাসেলস-এ। সেখানে তাঁর মতনই পালিয়ে আসা কিছু সমাজতন্ত্রী  Moses HessKarl Heinzen, and Joseph Weydemeyer ইত্যাদি মানুষের সাথে দেখা হয় পরের দিকে এই গোষ্ঠিকে আরও জোরালো করতে  এঙ্গেলস ও ব্রাসেলসে আসেন।
ইতিমধ্যে তিনি ও এঙ্গেলস  The German Ideology লেখা শুরু করেন যার ফলে  Ludwig FeuerbachBruno BauerMax Stirner প্রমুখের সাথে বিরোধ বৈরিতা শুরু হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে লেখা এই বইয়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাদের দর্শন তুলে ধরেন। খুবই ব্যঙ্গাত্মক ভংগিমায় লেখা এই বই মার্ক্স ও এঙ্গেলসের জীবদ্দশায় প্রকাশ হতে পারেনি, প্রথমদিকের আরো অনেক লেখার মতই এই বইও প্রকাশিত হয় বহু পরে ১৯৩২ সালে David Riazanov দ্বারা মস্কোর Marx-Engels Institute মাধ্যমে।   
কম্যুনিস্ট ইশতিহার প্রথম জর্মন খন্ড


১৮৪৭ সালে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস যোগ দেন কম্যুনিস্ট লিগ  Communist League-এ। সেই বছরের নভেম্বর মাসে লিগের দ্বিতীয় সাধারণ সম্মেলনে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে কার্ল মার্ক্স যৌথভাবে একটি কাজের ঘোষনা করেন শ্রমিকশ্রেণীর অমোঘহাতিয়ার যার নাম ‘কম্যুনিস্ট ইস্তিহার’ The Communist Manifesto ২১ ফেব্রুয়ারী ১৮৪৮ এ প্রকাশিত এই রচনায় তাঁরা দেখান যে ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা হচ্ছে অপর এক শ্রেণীকে দমন করার জন্য এক শ্রেণীর হাতে সংগঠিত ক্ষমতা’। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত এই ছোট্ট পুস্তিকা গোটাইউরোপ-এ আলোড়ন তোলে।
১৮৪৮ সালে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হলে মার্ক্স-কে বেলজিয়াম থেকে বিতাড়িত করা হয়। সেখান থেকে প্যারিসের বুর্জোয়া বিপ্লবের ঝড় ঝাপটা পেড়িয়ে সপরিবারে মার্ক্স পৌঁছন জার্মানির কোলোন শহরে। সেখানে তিনি ‘রাইন অঞ্চলের নতুন সংবাদপত্র’ Neue Rheinische Zeitung, নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। তবে খুব বেশী দিন নয়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে আবার তাঁকে বেঁছে নিতে হয় নির্বাসিতের জীবন। মার্কসরা চলে যান পারী'তে, সেখান থেকে আবার নির্বাসিত হয়ে লন্ডন-এ। বাকি জীবনটুকু তাঁদের সেখানেই কাটে।
১৮৬৪ সালে তৈরি হলো শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংঘ। প্রথম আন্তর্জাতিক   নামেই এই সংগঠন প্রসিদ্ধ। ১৮৭১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিকের ফরাসি বিপ্লবীরা প্রতিষ্ঠা করেন প্যারিস কম্যুন Paris Commune। কম্যুনার্ডদের হঠকারী সিদ্ধান্তের সাথে মার্ক্স-এঙ্গেলস একমত না হলেও, তাঁরা তাকে স্বীকৃতি জানাতে ভোলেননি। যাইহোক, খুব বেশীদিন টেকেনি এই সংগঠন। ১৮৭২ সালে হেগ সম্মেলনে রুশ নৈরাজ্যবাদী নেতা Mikhail Bakunin এর সাথে মার্ক্স-এর প্রবল বিতর্ক হয় এবং বাকুনিন বিতাড়িত হন। বাকুনিনপন্থীদের হাত থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিকের কার্যালয় স্থানান্তরিত করা হয় আমেরিকার ন্যুইয়র্ক-এ। ১৮৭৬-এর ফিলাদেলফিয়া সম্মেলনের পর প্রথম আন্তর্জাতিকের পতন ঘটে—শেষ হয় শ্রমিক আন্দোলনের এক বৈচিত্র্যময় অধ্যায়।

মার্ক্সের সমাধি হাইগেট, লন্ডন
১৮৮৩ সালে চরম অর্থ কষ্টের মধ্যে মার্কস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় তাঁর স্ত্রীর সমাধিস্থলের পাশে, হাইগেট গোরস্থানে।
#এঙ্গেলসর সাথে মিলে মার্কস গভীর ভাবে ধ্রুপদী জার্মান দর্শন, বিলিতি চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি কল্পাস্বর্গী সমাজবাদের মূল নীতিগুলো অধ্যয়ন করেন এবং গড়ে তোলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদ, যা পরবর্তীতে মার্কসবাদ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর মানে কখনই এমনটা নয় যে এই তিনটে বিশেষ উপাদানের মিশ্রণে মার্কসবাদ তৈরি। মার্কস জানতেন যে এই তিন আদর্শের ভিতরেও অনেক খামতি আছে। তাই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং বিশ্লেষণ ক’রে একেকটার ইতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত করেন, বিকশিত করেন এবং একটা বিশেষ পর্যায়ে এসে বিকশিত ইতিবাচক দিকগুলোর সংশ্লেষ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন তাঁর মতবাদ। এই মতবাদ বহুমুখী। আমাদের আরো জানার বাকী তবু কিছু আলোচনা রেখে যেতে চাইছি পাঠকেরা মতামত দিলে বাধিত হব।
#জার্মান চিন্তাবিদ হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনে প্রতিটি বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। হেগেল এবং মার্ক্স দু’জনেই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে হেগেল সবকিছুতে ছিলেন ভাববাদী আর মার্ক্স ছিলেন বস্তুবাদী। মার্ক্স এর নিজের ভাষায় তিনি হেগেল এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে মস্তিষ্ক (ভাব) থেকে পাঁয়ে (বস্তু) নামালেন, বলা যায় একেবারে উল্টিয়ে দিলেন। হেগেল-এর দ্বাদ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ভাববাদী ভ্রান্তিগুলো মার্কস শুধরে নেন এবং লুডভিগ ফয়েরবাখ-এর বস্তুবাদী ধারনার অসংগতিগুলোকে দূর করেন, এবং এদের সংশ্লেষ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন মার্কসবাদী মতবাদের দার্শনিক বুনিয়াদ—দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। মার্কসীও দ্বন্দ্বমূলক মতবাদ হ’ল একটা বিশেষ ধরণের বিচারধারা যা বস্তু কণার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিপরীত গুণের সমন্বয় ও তার পরিমাণের কমবেশি হওয়ার ভিতর দিয়ে বস্তু কণার গতিময়তা, পরিবর্তন ও বিকাশের প্রক্রিয়াকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অধ্যয়ন করে এবং তার বিপরীত গুণাবলীর ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে নতুন বস্তুতে রূপান্তরের বিষয়টা সামনে আনে। অতএব আমরা বলতে পারি যে দ্বান্দ্বিকতার মূলসূত্র হ’ল— (১) একই বস্তুকণার মধ্যে বিপরীত গুণের সমন্বয়, (২) পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন, (৩) বিপরীত গুণের ঘাতপ্রতিঘাতের ফলে নতুন বস্তুর উৎপত্তি। মার্কসীও বস্তুবাদ শেখায় যে এক মাত্র বস্তুজগতেরই অস্তিত্ব আছে এবং আমাদের চেতনাও বস্তুজাত। তাই মন বা ভাবের অস্তিত্ব বস্তু ছাড়া সম্ভব নয়, এবং এই বস্তু সদাই গতিশীল (এর ফলে বস্তুজাত জ্ঞানও গতিশীল)। পরবর্তীকালে এঙ্গেলস দেখান যে শুধু সমাজ বিজ্ঞানেই নয়, মার্কসীও দ্বন্দ্বমূলক মতবাদ প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।#দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে মার্কস আবিষ্কার করেন ‘মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম’। তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন, ‘রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রাথমিক ভাবে দরকার খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, বাসস্থান’। অতএব প্রাণধারণের জন্য সকল প্রকার উপাদান উৎপাদন করতে হবে। ‘এই অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হ’ল সেই ভিত্তি যার উপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যানধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাঁদের ধর্মীও ভাবধারা পর্যন্ত…’। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ শিক্ষা দেয় যে, সমাজ জীবনের পরিবর্তন সাধিত হয় উৎপাদনের শক্তির পরিবর্তনের ফলে, এবং এর ফলস্বরূপ উৎপাদনের সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো আপনাআপনি ঘটে না। এগুলো ঘটে এক শ্রেণীর সাথে আর এক শ্রেণীর দ্বন্দ্বের কারণে।
#পুঁজিবাদী সমাজের গতিধারা উদঘাটন করেন মার্কস। তিনি দেখান কিভাবে মূল্যতত্ত্বের সাথে উদ্বৃত্ত মূল্যের ব্যপারটা জড়িয়ে থাকে। এডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো যে মূল্যের শ্রমতত্ত্ব আবিষ্কার করেন। মার্কস তাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান এবং বিকশিত করেন। ‘তিনি দেখান যে পণ্য (পুঁজিবাদী সমাজে পণ্য উৎপাদনই প্রধান। মার্কস-এর ‘পুঁজি’ গ্রন্থও তাই শুরু হয়েছে পণ্যের আলোচনা দিয়েই) উৎপাদনে সামাজিক ভাবে যে আবশ্যক শ্রম-সময়ের ব্যয় হয়েছে, তা দিয়েই তার মূল্যের নির্ধারণ হয়’।
#মার্কসীয় অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল উদ্বৃত্ত মূল্য। বুর্জোয়া সমাজে একজন পুঁজিপতি উদ্বৃত্ত আহরণ করে মুনাফার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে একজন পুঁজিপতি উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয়, এবং তাই একজন শ্রমিক-কে, যে নাকি উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন, তার শ্রমশক্তি সেই পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করতে হয় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতি একাধারে হয়ে ওঠে উৎপাদনের উপকরণের মালিক, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের শ্রমশক্তির মালিক, এমনকি উৎপাদিত দ্রব্যেরও মালিক! শ্রম দিবসের একটা অংশের জন্য সেই শ্রমিক মজুরি পায়, আর একটা অংশের জন্য পায় না। এই বিনা মজুরির অংশটাই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। 
#শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ
নিজের রাজনৈতিক-সামাজিক অবদানের কথা বলতে গিয়ে ১৮৫৩ সনে মার্কস ভেদমেয়ার-কে লেখেন— ‘বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং তাঁদের মধ্যে লড়াই, এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। ...নতুন যেটুকু আমি করেছি, তা হচ্ছে, এই প্রমাণ করা যে (১) শ্রেণীগুলোর অস্তিত্ব শুধু উৎপাদনের বিকাশের বিবিধ ঐতিহাসিক স্তরের সাথে জড়িত; (২) শ্রেণীসংগ্রাম থেকে স্বাভাবিক ভাবেই সর্বহারার একনায়কত্ত্ব আসে; (৩) এবং এই একনায়কত্ব সমস্ত শ্রেণীর বিলুপ্তি এবং একটা শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণ ছাড়া কিছু নয়। ...’
শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের অর্থ কি? এর অর্থ হ’ল শোষিত শ্রমিকশ্রেণীকে শাসক শ্রেণীতে উন্নীত করা, এবং জনগণের মূল অংশের গণতান্ত্রিক চাহিদাকে সুনিশ্চিত ক’রে উৎপাদনের উপায়সমূহকে সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করা এবং শ্রেণী ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা।
#‘গোথা কর্মসূচী’-র সমালোচনা ক’রতে গিয়ে মার্কস তুলে ধরেন যে পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভ থেকে জন্মলাভ করা কম্যুনিস্ট সমাজে, অর্থাৎসমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে, বুর্জোয়া সমাজের অবশেষ রয়ে যাবে এবং তাই তা সমাজতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ের অবস্থা থেকে পৃথক হবে। এই নতুন সমাজের প্রাথমিক অবস্থায় একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সমাজকে যতটা শ্রম দেবে, তার মর্মে সে একটা প্রমাণপত্র পাবে এবং তা দিয়ে সে সমাজের ভোগ্যবস্তুর ভাঁড়ার থেকে তার শ্রম মূল্যের সমপরিমাণ ভোগ্যবস্তু লাভ করবে। অর্থাৎ সে সমাজকে যতটা দেবে, অন্যরূপে ঠিক ততোটাই ফেরত পাবে। কিন্তু কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ে এই নিয়ম পরিবর্তিত হবে কেননা তখন শ্রম জীবনধারণের উপায়ের বদলে জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে দেখা দেবে, শ্রমবিভাগের জাঁতাকল থেকে মানুষ মুক্ত হবে এবং দৈহিক আর মানসিক কাজের পারস্পরিক বৈপরীত্য আর থাকবে না। এই নতুন ব্যবস্থায় প্রত্যেকে তার ক্ষমতা মতো শ্রম দেবে এবং তার প্রয়োজন মতো দ্রব্য পাবে।
#মার্কসবাদ এমনই একটা বিপ্লবী বিশ্ববিক্ষা যা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলে, বিকশিত হয়। মার্কসবাদ তাই শুধু মার্কস-এই থেমে থাকেনি, বিকশিত হয়েছে লেনিনবাদে, সেখান থেকে মাওসেতুং চিন্তাধারায়। আসলে মার্কসবাদ নিষ্ক্রিয় মানুষের দর্শন নয়, স্বক্রিয় মানুষের বিশ্ববীক্ষা।  প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের স্তর ডিঙিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুগের প্রথম এবং মাঝের স্তর পেরিয়ে আজ আমরা তার শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, কিছু নতুন দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, কিছু পুরনো দ্বন্দ্ব মুছে গেছে; তবু বদলায়নি খেটে খাওয়া জনতার বিপ্লবী কামনা। সময়ের সাথে সাথে তা বেড়েই চলেছে। তাই উৎপীড়কদের একদিন উচ্ছেদ করবেই এইসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, আর আগের মতোই সেই সংগ্রামের বাতিঘর হবেন এক বৃদ্ধ দার্শনিক, যার নাম কার্ল মার্কস।

মার্ক্সের গ্রন্থাবলী
১৮৪৮-এ প্রকাশিত ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহার’ ছাড়াও মার্কস বহু গুরুত্বপূর্ণ কেতাব রচনা করেছিলেন। ১৮৪৪ সালে মার্কস রচনা করেন ‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খসড়া’। ঐ বছর ব্রুনো বাওয়ার-এর মতামতের সমালোচনা ক’রে তাঁর প্রবন্ধ ‘ইহুদী প্রশ্ন প্রসঙ্গে’ প্রকাশিত হয়। তার পরের বছর (১৮৪৫) তিনি লেখেন ফয়েরবাখ-এর উপর তাঁর বিখ্যাত থিসিস। সেই বছরই এঙ্গেলস-এর সাথে মিলে রচনা করেন ‘পবিত্র পরিবার’ এবং ‘জার্মান মতাদর্শ’ নামে দুটো বই। ১৮৪৭-এ প্রুধোর ‘দরিদ্রের দর্শন’ নামক ইস্তাহারের সমালোচনা ক’রে মার্কস রচনা করেন ‘দর্শনের দারিদ্র’। ঐ একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘মজুরি শ্রম ও পুঁজি’ পুস্তিকা। ১৮৫২-তে মার্কস লেখেন ‘লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমিয়ের’।
৫-এর দশকের শেষ থেকে মার্কস অর্থশাস্ত্র বিষয়ে বিভিন্ন বই ও পুস্তিকা রচনা করেন।১৮৬৩তে Theories of Surplus Value ১৮৬৭-তে প্রকাশিত হয় তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ ‘পুঁজি’(প্রথম খণ্ড) Das Kapital। এখানে মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতিষ্ঠানগুলোকেকাটা-ছেঁড়া ক’রে তার শোষণের দিকগুলো উন্মোচিত করেন। তবে মার্কস পুঁজি শেষ ক’রে যেতে পারেননি। মার্কস-এর পাণ্ডুলিপির থেকে বই-এর পরের দুই খণ্ড সম্পাদনা করেন এঙ্গেলস। ১৮৭১ সালে প্যারিস কম্যুন সম্পর্কে মার্কস তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন ‘ফ্রান্স-এ গৃহযুদ্ধ’ বইতে। ১৮৭৫ সালে ল্যাসাল-এর মতাদর্শের আদলে গড়ে ওঠা কর্মসূচির সমালোচনা ক’রে তিনি লেখেন ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’।
এছাড়াও মার্কস অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা এবং প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর চিঠিপত্রের সংকলন এবং গাণিতিক পাণ্ডুলিপিটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষ নিয়েও মার্কস ছিলেন অত্যুৎসাহী। ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, ব্রিটিশ শাসনের চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে তিনি গভীর ভাবে চর্চা করেন এবং কিছু কালজয়ী নিবন্ধ রচনা করেন। মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর যৌথ সংগৃহীত রচনাবলীর সংখ্যা মোট ৫০।

*** সমাজতন্ত্র পেজ, marxists.org, এর কাছে আমরা বাধিত , কিছু উইকিপেডিয়া লিঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিস্তারিত জানার জন্যে। সকলকে ধন্যবাদ